নির্বাচনের আগে সাংবাদিকদের ওপর আরো চাপ

Share

জাতীয় নির্বাচনের আগে সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। নানা ধরনের চাপের মুখে পড়তে হয় সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যমকে। এবারও এই পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।সাংবাদিকদের জন্য তথ্য অধিদপ্তরের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড কমিয়ে দেয়া এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সরকারে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে “গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো” সুবিধা দেয়ায় ওই আশঙ্কা বেড়েছে।

নিয়ন্ত্রণের নানা কৌশল:

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নির্বাচনের আগে সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যমের ওপর চাপ সরকারের দিক থেকে যেমন থাকে তেমনি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকেও আসে। রাজনৈতিক দলগুলো তখন সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অন্যদিকে সাংবাদিকদের পেশদারত্বের অভাব। সুযোগ সুবিধার প্রলোভন ও নানা ধরনের হুমকিও তখন বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করে। আর সবার উপরে থাকে সংবাদ মাধ্যমের মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন এই চাপটি বেশি আসে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। আইন ও প্রভাব খাটিয়ে এবং সংবাদমাধ্যমের মালিকদের কব্জায় নিয়ে তাদের পক্ষে সাংবাদিক আর সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ । আর মালিকেরা যখন নিয়ন্ত্রণে আসেন তখন সাংবাদিকদের আর তেমন কিছু করার থাকে না। তাদের চাকরি হারানোর ভয় থাকে। সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের বড় হাতিয়ার হলো সরকারি বিজ্ঞাপন।

চাপের রাজনৈতিক লক্ষণ:

নির্বাচনের এক বছরেরও বেশি সময় বাকি থাকলেও চাপের কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি দুই দফায় সংবাদ মাধ্যমের প্রতি অভিযোগ তুলেছেন। তিনি গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন,”মিডিয়া আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিকে বেশি কাভারেজ দিচ্ছে। তারা বিএনপির নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরছেনা।”

২৮ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় আরেক অনুষ্ঠানে বলেন,”পত্রিকায় আওয়ামী লীগের কোনো নিউজ নেই। তারা বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে উসকানি দিচ্ছে।” আওয়ামী লীগের আরো অনেক মন্ত্রী এবং নেতা এখন বার বার দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার কথা বলছেন।

অন্যদিকে বিএনপিও মনে করে,”সংবাদমাধ্যম প্রকৃত তথ্য তুলে ধরছে না। কোনো সংবাদমাধ্যম একপেশে খবর পরিবেশন করছে।” ফলে দুই দিক থেকেই চাপে আছেন সাংবাদিকেরা।

আইনের ফাড়া:

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও আরো অনেক আইন ও বিধি নিয়ন্ত্রক হিসেবে আছে। আইনগুলো হলো আদালত অবমাননা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট, বাংলাদেশ দন্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, কপিরাইট আইন, প্রেসকাউন্সিল অ্যাক্ট, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, পোস্ট অফিস অ্যাক্ট, শিশু আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, তথ্য অধিকার আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ভোক্তা অধিকার আইন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধান।

আর্টিকেল-১৯-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাবেক প্রধান তাহমিনা রহমান বলেন,”আমরা অভিজ্ঞতায় দেখেছি নির্বাচনের আগে থেকেই সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এটা সবাই করতে চায়। কিন্তু সরকারি দল যেহতু ক্ষমতায় তাই তারা এটা বেশি করে। তারা ডিএসএ অ্যাক্টসহ নানা আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। মামলার হুমকি দেয়। তাই নির্বাচনের সময়টাতে সাংবাদিকদের অনেক বেশি চ্যালঞ্জের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সংকুচিত করার নানা চেষ্টা চলে।”

তার মতে,”এই আইনগুলো সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচনের আগেই বেশি ব্যবহার হয়। এর আগে আমরা ডিএসএ অ্যাক্ট সাংবাদিকদের ওপর ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে দেখেছি।”
সাংবাদিকেরা যা বলছেন:
বাংলাদেশে নির্বাচন সাংবাদিকতায় অনেক দিনের অভিজ্ঞ এবং একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক মনির হোসেন লিটন বলেন,”নির্বাচন সংক্রান্ত প্রতিবেদন করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা নিজেদের দুর্বলতার কারণে প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন আইন কানুন ঠিকমতো না জানার কারণে। আরেকটি হলো সাংবাদিকদের রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত থাকা। ফলে বড় রাজনৈতিক দলগুলো অনুগত সাংবাদিকদের যেভাবে নিউজ ফিড করে দেয় তারা সেভাবে নিউজ করে।”

তার কথা, আর নির্বাচনের আগে দেশে প্রচলিত সব ধরনের আইনই তো কার্যকর থাকে। ওই আইনগুলো প্রয়োগের প্রবণতা বেড়ে যায়। সাংবাদিকেরা ওই আইনগুলোর হুমকির মুখে থাকে। প্রচ্ছন্ন চাপ দেয়া হয় বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন,”বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর মালিকদের দেখে আসছি তারা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুগত থাকেন। কেউ কেউ সরাসরি যুক্ত থাকেন। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকে। তাই সেখানে সাংবাদিকদের কিছু করার থাকে না। তাদের ইচ্ছার বাইরে গেলে সাংবাদিকদের চাকরির ভয় থাকে।”

তার কথা,”এই চাপ নির্বাচন কমিশনের চেয়ে রাজনৈতিক দলের দিক থেকে বেশি আসে। বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের দিক থেকেই বেশি আসে।”

তবে নির্বাচন কমিশনও সাংবাদিকদের চাপ ও চ্যালেঞ্জের মুখে রাখে বলে বলেন জানান বাংলাদেশ পার্লামেন্ট জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মশিউর রহমান। তিনি বলেন,”নির্বাচন কমিশন চায় তারা যেমন ইচ্ছে করেন আমরা যেন সেরকম প্রতিবেদন করি। এটা না হলে তারা নানা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। যেমন এখন নির্বাচন কমিশনে আমাদের প্রবেশ সংকুচিত করা হয়েছে। আগে সাংবাদিকেরা সহজেই সেখানে যেতে পারতেন। এখন নির্বাচন কমিশনের পরিচয় পত্র দিয়ে তা সংকুচিত করা হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য কর্মকর্তাদের কাছে যেতেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।”

তার কথা,”নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এখনই আমরা চাপের মুখে আছি। আবার নির্বাচনের সময় প্রার্থী, কমিশনের কর্মকর্তা এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চাপে থাকব। সবাই চায় সাংবাদিকদের তাদের মতো ব্যবহার করতে।”
সূত্র:ডয়েচে ভেলে

Leave A Reply