প্রতিবেদন
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারে কে থাকবে তা নিয়ে আলোচনা ও বিরোধ চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) অবৈধ ঘোষণা করায় এবং সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করায় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্ধারিত তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে না পারলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অপরদিকে, নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক।
নির্বাচনকালীন সময়ের সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই অনেক প্রস্তাবনা দিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এসব প্রস্তাবনা এসেছে। তবে এখনো যে কথাটি আসেনি তা হলো, ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’। গণতান্ত্রিক বিশ্বে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ কোন নতুন বিষয় নয়। উন্নত ও আধুনিক সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রায় সকল রাষ্ট্রেই ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ বিদ্যমান। শুধু উন্নত দেশ নয়, অনেক উন্নয়নশীল, মধ্যম আয় ও নিম্ন আয়ের দেশেও ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে।
বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশি দুইটি রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার। ভারতকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ বলা হয়ে থাকে। সেই ভারতে কাউন্সিল অফ স্টেটস (রাজ্যসভা) ও কাউন্সিল অফ দ্যা পিপল (লোকসভা) নামে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে। আরেক প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার, যেখানে সামরিক জান্তার প্রভাবে গণতন্ত্র মৃতপ্রায় সেখানেও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ও পিপলস অ্যাসেম্বলি নামে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে।
যে যুক্তরাজ্য আমাদের ১৯০ বছর শাসন করেছে, যাদের আইন- নীতি বংশানুক্রমে বাংলাদেশ এখনো বহন করে যাচ্ছে সেই দেশেও কিন্তু ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ কার্যকর, যা হাউজ অফ লর্ডস ও হাউজ অফ কমন্স নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন জটিলতার সমাধান পাওয়া যায় ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ ব্যবস্থায়। যেখানে সংসদের দুইটি কক্ষ থাকে। একটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও অপরটি বিদ্যমান থাকে, ফলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেওয়ার সুযোগ থাকে না।
অপর দিকে সংসদের দুটি কক্ষ থাকায় নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বা নির্বাচনে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকে না। আবার সংসদের দুটি কক্ষেই নির্বাচিতরা থাকায় অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার গঠনের প্রশ্নই আসে না। সুতরাং ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভূমিকা রাখে। প্রধানমন্ত্রী সংসদের নিম্নকক্ষ বা রাজনৈতিক পরিষদের নেতা হলে রাষ্ট্রপতি সংসদের উচ্চকক্ষ বা বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারেন।
সংসদের নিম্নকক্ষ বা রাজনৈতিক পরিষদে সকল দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকলেও উচ্চকক্ষ বা বিশেষজ্ঞ পরিষদে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ, বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নির্বাচিত, দক্ষ ও অপেক্ষাকৃত প্রবীণদের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। ফলে উচ্চকক্ষ ও নিম্ন কক্ষের মধ্যে এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ কাজ করবে। উচ্চকক্ষ যেমন জনবিরোধী কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না আবার তেমনি নিম্ন কক্ষ কোন অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত নিলে বিশেষজ্ঞ পরিষদ সেটা ঠিক করতে পারবে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি প্রভৃতি দেশে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট ও হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ নামে দুইটি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া রাশিয়ায় ফেডারেশন কাউন্সিল ও স্টেত ডুমা, ফ্রান্সে সিনেট ও ন্যাশনাল এসেম্বলি, অস্ট্রেলিয়ায় সিনেট ও হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ, জার্মানিতে ফেডারেল কাউন্সিল ও ফেডারেল ডায়েট নামে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ বিদ্যমান।
এমনকি আফ্রিকা মহাদেশের মিশর, সুদান, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান প্রভৃতি দেশগুলোতেও ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে। মিশরে মজলিসে শুরা ও মজলিসে সা’ব, সুদানে ন্যাশনাল লেজিসলেচার ও কাউন্সিল অফ স্টেটস, ইথিওপিয়ায় হাউজ অফ ফেডারেশন ও হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ, দক্ষিণ সুদানে ন্যাশনাল লেজিসলেচার ও কাউন্সিল অফ স্টেটস নামে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান, মালয়েশিয়া, কাজখাস্তান, ওমান, উজবেকিস্তান প্রভৃতি দেশে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে। জাপানে হাউজ অফ কাউন্সিলর্স ও হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস, মালয়েশিয়ায় সিনেট ও হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস, কাজখাস্তানে সিনেট ও অ্যাসেম্বলি, ওমানে মজলিসে শুরা ও মজলিসে দৌলা, উজবেকিস্তানে সিনেট ও লেজিসলেটিভ চেম্বার নামে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা ছাড়া অন্যান্য দেশে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ কার্যকর। পাকিস্তানে সিনেট ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, আফগানিস্তানে হাউজ অফ এল্ডার্স ও হাউজ অফ দ্যা পিপল, ভুটানে ন্যাশনাল কাউন্সিল ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, নেপালে ন্যশনাল অ্যাসেম্বলি ও হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস নামে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে।
‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ নির্বাচন সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ থেকে উন্নত নয় এবং সমপর্যায়ের অনেক দেশেই ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ রয়েছে। তাই, ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ বাংলাদেশের জন্য কোন বিলাসিতা নয়।
নির্বাচনকালীন জটিলতা ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সর্বোপরি দেশের গণতন্ত্রের উন্নয়নের স্বার্থে বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক ও উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ‘দ্বি- কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য এখন সময়ের প্রয়োজন ও বাস্তবতা।