জাসদীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি।। :আহমেদফজলুর রহমান মূরাদ

Share

বর্তমান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একটি অংশ বুর্জোয়া দলের সাথে যে ক্ষমতাশ্রয়ী ঐক্য করছেন তাতে মনে হচ্ছে দলটি ক্রমেই তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাতে বসেছে।।রাজনীতিতে বিভিন্ন আন্দোলন প্রশ্নে জোট বা ঐক্য কোন অপরাধ নয় তবে সেটা হতে হবে দলের নিজস্বতা বজায় রেখে কোন দলের লেজুড়বৃত্তি করে নয়।।এর আগেও বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন প্রশ্নে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বুর্জোয়া দুটি দলের সাথেই ঐক্য করছে বা যুগপৎ ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।। এমনকি ঐকমত এর সরকারেও যোগ দিয়েছে। কিন্তু এবারের ক্ষমতাশ্রয়ী ঐক্য জনমনে দলটির অবস্থানকে ভিন্নভাবে উপাস্থিত করেছে।।দলটি বর্তমান সরকারের সাথে থেকে বর্তমান সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, দুঃশাসন, দখলবাজি,ভোট কারচুপির নুন্যতম কোন প্রতিবাদ করতে পারছেন না যা জাসদের রাজনীতির সাথে বেমানান।। তাছাড়া সরকারের বিভিন্ন গনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমর্থনে মুখপাত্রের ভুমিকা রাখছেন তাতেও জনমনে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে যা আগে কখনওই পরিলক্ষিত হয় নাই।।এই ঐক্য আজ আপোষের চোরাগলিতে হারিয়ে যেতে বসেছে যা জাসদের নেতাকর্মীদের কাছে কাম্য নয়।।

রাজনীতিতে চলমান দ্বিদলীয় ক্ষমতার চক্রবাক থেকে বের হতে বিকল্প শক্তিকে আমরা স্বাগত জানাই তারমানে আবার এটা নয় যে আবার পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীশক্তি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক।।সেটাও তারা কতটা নিশ্চিত করতে পারবেন তাও সন্দিহান ।। তাছাড়া দুই বুর্জোয়া দলের সাথেই দলটির রয়েছে এক তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতা, হাজার হাজার সাথীদের রক্তের দায় বিশেষ করে জাসদের হাজারো নেতাকর্মী হত্যা অপরদিকে জাসদের প্রাণপুরুষ বীর বিপ্লবী কর্নেল আবু তাহেরের ফাসী।।এইসব বিবেচনা করেই আমরা মনে করছি আমাদের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে নিয়ে নুতন করে ভাবা উচিৎ আর সেই তাগাদা থেকেই আমরা দলের তৃনমূল নেতাকর্মীদের ঐক্যের বিষয়টিকে জোর দিয়েছি।।

সব রাজনৈতিক শক্তির আক্রমণের লক্ষ্য ‘জাসদ’। রাজনীতিতে যে ক্রান্তিকাল চলছে তা কাটিয়ে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আছে একমাত্র ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের । এখনও সংগঠনটির অগণিত কর্মী ও নিষ্ক্রিয় সমর্থক আছে- যাদেরকে একত্রিত করে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ঘটানো সম্ভব। বর্তমান সময়ে নতুন মেরুকরণের দু’টি সম্ভাবনা আছে- একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি, অন্যটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির। আর প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা রাখে একমাত্র ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের । আর এজন্যই আক্রমণের লক্ষ্য ‘জাসদ’। কেননা ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আছে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কর্মসূচী। এ বিষয়টি সংগঠনটির নেতা-কর্মীকে অনুধাবণ করতে হবে। যদিও বিষয়টি ‘দলটিরর কোনো খন্ডিত অংশের নেতারা অনুধাবণ করেন না। তাঁদের বিশ্বাসহীনতা সংগঠনের বিকাশের বিপরীতে নিজেদের বৈষয়িক বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়েছে। এ মুহুর্তে সমস্ত খন্ডিত অংশের কর্মীবাহিনীর উচিত নেতাদের বাধ্য করা ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে। প্রয়োজনে এসব নেতাদের সাথে বৈঠকের উদ্যোগ নিতে হবে, রাজী না হলে এঁদের বয়কট করার মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব উদ্যোগকে সফল করতে সমস্ত খন্ডিত অংশের কর্মীদের নিয়ে কনভেনশনও ডাকা যেতে পারে।।

আমরা মনে করছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, তার কতগুলো স্পষ্ট ঘোষিত প্রতিশ্রুতি ছিল। যেমন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার। কিন্তু এই রাষ্ট্র কায়েমের পরে সেই প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষিত হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত স্রোতে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য, আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তুলব। এবং তা করতে গিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করব; সেখান থেকে একটা নতুন রাজনৈতিক শক্তি ও দল গড়ে উঠবে।।

জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি যারা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতকরা পঁচাশি জনই নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। অবশিষ্ঠ পনেরো ভাগ দলটির তিনটি বিভক্তি এবং সাবেক নেতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত দু’একটি সংগঠনের মাঝে রয়েছেন।আবার অনেক ত্যাগীনেতাদের একটি অংশ দল ত্যাগ করে বিএনপি আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টিতেও যোগ দিয়েছেন।
এই বক্তব্য যদি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে যুগপৎ হতাশ এবং আশাবাদী হতে হওয়ার কারণ রয়েছে। হতাশা এই জন্য যে, সংগঠনিক বিস্তৃতি এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারতো, তারা আজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টায় ব্যস্ত। আর আশাবাদী হওয়ার কারণ এই যে, নিস্ক্রীয় এই শতকরা পঁচাশি জনকে এক কাতারে শামিল করতে পারলে দলটি আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূলস্রোতের দল হিসেবে দাঁড়াতে পারে।

দেশের রাজনীতিতে এখন গভীর শুন্যতা বিরাজ করছে। এই শুন্যতা এক সময় না এক সময় পূরণ হবে। হতে পারে সেটা আরও খারাপ কোন শক্তির মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িকতা এবং গনতন্ত্রের পথে পরিচালিত করতে হলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মতো অসাম্প্রদায়িক দলকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সে দায়িত্ব পালন করতে হলে নিস্ক্রীয় নেতা-কর্মিদের আবার সক্রিয় করে দলকে শক্তিশালী করতে হবে। এ পথে চিন্তা যারা করেন, তারা ঐক্যবদ্ধ জাসদীয় ঐক্য গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে দেখতে গেলে এমন হঠাৎ করে জাসদীয় ঐক্য সম্ভব নয়। আবেগের নয়-হতে হবে রাজনৈতিক ঐক্য। সেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঐক্যের পথে হাঁটতে হবে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মূল বিভক্তিটা এসেছিল এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়। এরশাদ পতনের ত্রিশ বছর পর এখন আমাদের উপলব্ধি, এরশাদের পক্ষ-বিপক্ষ দলটির উভয় অংশই লাভের পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ইতিমধ্যে এরশাদ স্বৈরাচারও জায়েজ হয়ে গিয়েছে রাজনীতিতে। তাই ওই পর্বটি উপেক্ষা করে আরেকটু পেছনে গিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। আশি সালে দলের আঠারো দফার ব্যাপারে কারো কোন আপত্বি থাকার কথা নয়। আঠারো দফার মূল বিষয় দ্বি-কক্ষ পার্লামেন্টের দাবি যা দলটির সবাই বিশ্বাস করেন। প্রয়োজনীয় নবায়নের পর আঠারো দফাকে ভিত্তি ধরে দলটির সকল গ্রুপ পৃথকভাবে কর্মসূচি প্রনয়ন করে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। তারপর রাজপথের বাস্তবতায় সব গ্রুপগুলোকে নিয়ে জাসদীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলা যেতে পারে। সব গ্রুপের অভিজ্ঞ নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি স্টিয়ারিং কমিটি এই ফ্রন্ট পরিচালনা করবেন। সেক্ষেত্রে নেতাদের নেতৃত্বও বজায় থাকবে আবার সবাই এক কাতারে শামিলও হওয়া যাবে। তারপর রাজপথের বাস্তবতায় ফয়সালা হবে ঐক্যের বিষয়টি। এটি একটি প্রস্তাবনা মাত্র। এমন আরও ফর্মূলা আসতে পারে সক্রিয়-নিস্ক্রীয় নেতা-কর্মিদের কাছ থেকে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মিই ভাল সংগঠন বোঝেন। তাঁরাই বলে দেবেন সমাধানের পথ।

বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতায় ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক জনাব নাজমুল হক প্রধান বাংলাদেশ জাসদের বিভিন্ন সন্মেলনে “”আমি সারাদেশের সকল জাসদ নেতা কর্মীদের আহবান জানাতে চাই ক্ষমতালোভী কতিপয় নেতা-নেত্রীর ব্যক্তিগত খায়েশের রাজনীতি পরিত্যাগ করে শহীদ সিদ্দিক মাষ্টার এডভোকেট মোশাররফ হোসেন রশিদ রবি হেলাল হাদি মন্টু, শাহজাহান সিরাজ,ডাঃ মিলন, কর্নেল তাহের, কাজি আরেফ আহমেদ সহ হাজার শহীদের রক্তে গড়া সংগঠন জাসদকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে শামিল হউন। জয় আমাদের হবেই।” ঘোষণা দিয়ে আগামী দিনের লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন।তার এ জাতীয় আহ্বান একটি রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে সবাই একমত হয়েছেন যা সারাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সক্রিয় ও নিস্ক্রিয় নেতাদের মধ্যে একটা আশার আলো সৃষ্টি করেছে। আমাদের প্রত্যাশা এ ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে হয়তো কতিপয় সরকারের সুবিধাভোগী ছাড়া বাকি সকল নেতাকর্মী যুক্ত হয়ে যাবেন।।

‘দলটির সব গ্রুপই সমতা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে। তাহলে সবাই একসাথে চলতে পারবেন না কেন?’ , ‘ঘুরে দাঁড়িয়ে মূলস্রোতের দল হিসেবে নিজেদের প্রমান করতে না পারলে দলের বিলুপ্তি ঠেকানো যাবে না’। দলটির নেতা-কর্মিদের এই বাস্তব উপলব্ধিই এই দলকে আবার বাংলাদেশের রাজনীতির মূল স্রোতে নিয়ে আসবে।

রাজনৈতিক নীতি-কৌশল এক থাকার পরও দলটি ভেঙ্গেছে। তবে কি তা শুধুমাত্র নেতৃত্বের কোন্দলে? একই কারণে এদেশের বেশ কয়েকটি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল অনন্য বৈশিষ্ঠের একটি রাজনৈতিক দল। তারা ঘুরে দাঁড়াবে। বাস্তবতার চাহিদায় ডান-মধ্য-বাম ঐক্য করে। তাহলে একই মত-পথের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এক ছাতার নীচে দাঁড়াতে পারবে না কেন? শেকড়বিহীন দলের নেতা হওয়ার চাইতে বড় দলের কর্মি হওয়া ভাল। আমি মনে করি ১৯৭২ সালে জাসদ গঠন যেমন অনিবার্য ছিলো জাসদ ভাগও অনিবার্য পরিণতি ঠিক একইভাবে জাসদের ঐক্যও আজকে অনিবার্য।।

আগামী ৩১শে অক্টোবর থেকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ৫০ বছরে পূর্ণ হবে। আমরা চাই আগামী ২০২২ সালের ৩১শে অক্টোবরে ঐক্যবদ্ধভাবে দলের ৫০ বছর পুর্তি পালন হোক। সেই উদ্দেশ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল আবারও জনগণের দল হিসেবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে- সেই শুভ দিনের প্রত্যাশায় অপেক্ষমান রয়েছে অজস্র সংগ্রামী মানুষ।।সেটাই যেন সফল হয়।।

Leave A Reply