ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী: সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ

Share

মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলেন লিজ ট্রাস। গত জুলাই মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পদত্যাগ করলে, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ট্রাস।
মঙ্গলবার স্কটল্যান্ডের বালমোরালে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের সাথে একান্ত বৈঠকে ট্রাসকে নতুন সরকার গঠন করতে বলা হয়। ৯৬ বছর বয়সী রানী স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে লন্ডনে যেতে না পারায়, বৈঠকটি স্কটল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়।
রানী এলিজাবেথ দ্বারা নিযুক্ত ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হলেন ট্রাস, এবং মাত্র সাত বছরে তিনি চতুর্থতম রক্ষণশীল দলের নেতা – যা রানীর দীর্ঘায়ু এবং ব্রিটেনের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত৷ বরিস জনসন রানীর সাথে দেখা করতে স্কটল্যান্ডে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর ট্রাসের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
ট্রাস পরে লন্ডনে ফিরে যান। সন্ধ্যায়, তিনি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে একটি টেলিভিশন ভাষণে সরকারের অগ্রাধিকারের রূপরেখা তুলে ধরেন।

জ্বালানি সংকট
ট্রাস জনসনের সরকারের অধীনে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে পররাষ্ট্রনীতির বাজপাখি হিসেবে দেখা হয়, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশগুলোর বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত কঠোর নীতি গ্রহণের সংকল্প ব্যক্ত করেন।
ট্রাস বলেন, “আমরা এখন ইউক্রেনে রাশিয়ার ভয়ঙ্কর যুদ্ধ এবং কোভিড-পরবর্তী সৃষ্ট গুরুতর বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি। … আমাদের মিত্রদের সাথে একত্রিত হয়ে আমরা সারা বিশ্বে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য দাঁড়াবো।”

ট্রাস অবশ্য নিজ দেশেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন।
তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট জ্বালানি সঙ্কট থেকে বাঁচতে ব্রিটিশদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কারণ গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম আগামী মাসগুলিতে আট গুণ বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উল্লেখ করে ট্রাস বলেন, “পুতিনের যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জ্বালানি সংকট আমি শক্ত হাতে মোকাবেলা করব।”

বিবিসি মঙ্গলবার জানিয়েছে, ট্রাস আগামী ১৮ মাসের জন্য জ্বালানি সংস্থাগুলিকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে ১৫ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত জ্বালানি বিল পরিশোধ করার পরিকল্পনা করছেন। এই সপ্তাহের পরের দিকে এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

লন্ডন-ভিত্তিক গবেষণা গ্রুপ চ্যাট্যাম হাউজের বিশ্লেষক জন ক্যাম্পফনার ভিওএ-কে বলেছেন, যে কোনও রাজনৈতিক মধুচন্দ্রিমা সাধারণত স্বল্পস্থায়ী হয়। “তার নব্বই শতাংশ সময় এখানে এবং এখন অভ্যন্তরীণ এজেন্ডা নিয়ে কাজ করতে হবে – বিশেষ করে, সংকটে থাকা অর্থনীতি, ধর্মঘট, স্বাস্থ্য পরিষেবা (সঙ্কটে), বিপুল জ্বালানি বিল, সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে।”
জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় খরচ হলেও, ট্রাস কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ইউক্রেন
ট্রাস জিডিপি’র ৩% প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্লেষক গোষ্ঠী রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই) অনুমান করেছে, এতে করে অতিরিক্ত ১৮ হাজার ডলার ব্যয় হবে। ইতোমধ্যে, তিনি ইউক্রেনকে সামরিক ও মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ব্রিটেন এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি, যিনি বরিস জনসনের ক্ষমতায় থাকার পক্ষে তার আকাঙ্ক্ষা গোপন করেননি, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ট্রাসের নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার অনলাইনে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে জেলেন্সকি বলেছেন, “ইউক্রেনে, আমরা তাকে ভালভাবে চিনি। তিনি সবসময় ইউরোপীয় রাজনীতির আলোকিত দিকেই ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি যে একসাথে, আমরা আমাদের দেশগুলির সুরক্ষার জন্য এবং রাশিয়ার ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা নিশ্চিত করতে আরও অনেক কিছু করতে সক্ষম হবো।”
বিশ্লেষক কাম্পফনারের মতে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর প্রতি ব্রিটেনে শক্তিশালী জনসমর্থন রয়েছে।

চীন
সরকারী মন্ত্রী হিসাবে, ট্রাস চীনের প্রতি আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে তিনি চীনা টেলিকম সংস্থা হুয়াওয়েকে ব্রিটেনের ফাইভ-জি নেটওয়র্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়া নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের নিল মেলভিন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন, “লিজ ট্রাস সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের চেয়েও বেশি যুদ্ধংদেহী।”

ইউরোপ
ট্রাস উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রোটোকলকে উপেক্ষা করে আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর পূর্বসূরি জনসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে স্বাক্ষরিত একটি মূল ব্রেক্সিট চুক্তি যা আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যে একটি কঠোর সীমান্তের প্রয়োজনীয়তা রোধ করেছিল, অনেকের ভয় ছিল এতে করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা পুনরুজ্জীবিত হবে। ক্যামফনার উল্লেখ করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
তিনি বলেন, “সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে ২৭টি ইউরোপীয় দেশ এবং ব্রিটেনের মধ্যে একটি পূর্ণ মাত্রায় বাণিজ্য যুদ্ধ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই, একেকটি করে বিপর্যয় নেমে আসবে, এই অবস্থা ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্যের বেশ ভয়ঙ্কর অর্থনীতির আগুনে ঘৃতাহুতি ঢালবে।”
কাম্পফনারের মতে, ব্রেক্সিট নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনার ফলে সৃষ্ট বিশেষ সম্পর্কটি ঘোলাটে হয়ে গেছে।

বিশেষ সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় ট্রাসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাইডেন লিখেছেন, “আমি আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ককে আরও গভীর করার এবং রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেন যখন নিজেকে রক্ষা করে চলেছে তখন ইউক্রেনের প্রতি অব্যাহত সমর্থনসহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলিতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করার অপেক্ষায় রয়েছি।
“আমেরিকানরা এবং বিশেষত বাইডেন প্রশাসন ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বেছে নেওয়ার বিষয়ে অবিশ্বাস্যরকম সতর্ক। তারা এটিকে একটি কৃত্রিম পছন্দ হিসাবে বিবেচনা করে।”

আগাম নির্বাচন?
ব্রিটেনের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হওয়ার কথা। ট্রাস মাত্র ৮১,০০০ রক্ষণশীল দলের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, যা সামগ্রিক ভোটারদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। কিংস কলেজ লন্ডনের, যুক্তরাজ্যের চেঞ্জিং ইউরোপ প্রোগ্রামের অ্যালান ওয়েগার বলেছেন, ট্রাসের অবশ্য আগাম নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে নতুন ম্যান্ডেট চাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

ওয়েগার ভিওএ-কে বলেছেন, “কনজারভেটিভ পার্টি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভোটের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে। সুতরাং এর ফলে একটি সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাবনা এখন নেই এখন প্রায় অত্যন্ত অসম্ভাব্য করে তোলে – কারণ বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একটি নির্বাচনই চায়। নতুন প্রধানমন্ত্রী এখনই ভোটারদের মুখোমুখি হওয়া এড়াতে যে কোনো কিছুই করবেন।”
সূত্র:ভয়েচ অব আমেরিকা

Leave A Reply