যুক্তরাজ্য প্রবাসী পরিবার নিয়েই রহস্য। বিপর্যস্ত ছিল গোটা পরিবার। মারা যাওয়া ছোট ছেলে মাহিকুল ইসলাম ছিল প্রতিবন্ধী। পঁচিশ বছর বয়সী বড় ছেলে সাদিকুল ইসলামও অসুস্থ। বিশ বছর বয়সী মেয়ে সামিরা ইসলাম সাইনো রোগী। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী রোশনারা বেগম দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে হতাশা। দিশাহারা ছিলেন রফিকুল ও রোশনারা। ১২ই জুলাই দেশে এসে তারা অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। মূলত সবার চিকিৎসার জন্যই এবার তাদের দেশে আসা।
বিজ্ঞাপন
৬ দিন ঢাকায় অবস্থানের পর রফিকুল যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে চলে যেতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু স্ত্রী রোশনারার অনুরোধে সিলেটে আসেন। ওঠেন ওসমানীনগরের তাজপুরের পাল হাউজে। ওই হাউজের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে তারা বসবাস করছিলেন। রোশনারার মা, বোন অসুস্থ। তাদের দেখতে সিলেটে আসা। মঙ্গলবার দুপুরে তাদের ৫ জনকেই ওই ফ্ল্যাট থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে হাসপাতালে আনার পর পরিবারের কর্তা রফিকুল ইসলাম ও ছোট ছেলে মাহিকুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনার পর গুরুতর ছিলেন রফিকুলের স্ত্রী রোশনারা ও মেয়ে সামিরা ইসলাম।
তবে হাসপাতালে ভর্তির পরদিনই সুস্থ হয়ে ওঠেন বড় ছেলে সাদিকুল ইসলাম। তাকে এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাখা হয়েছে। পরিবারের স্বজনরা জানিয়েছেন, সাদিকুল ও তার মা রোশনারা বেগম এখন কথাবার্তা বলতে পারছেন। সম্পূর্ণ ঘটনা এখনো তাদের জানানো হয়নি। আর সামিরা ইসলাম অসুস্থ অবস্থায় রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার থেকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত দফায় দফায় নিকট আত্মীয়দের নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিশেষ করে ওই দিন ঘরে থাকা দেলোয়ার ও স্ত্রী শুভাসহ ৩ জনকে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য মেলেনি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী ওই পরিবারের ভেতরকার নানা বিষয় তাদের সম্মুখে এসেছে। দুই ছেলে ও মেয়েই প্রাপ্ত বয়স্ক, তাদের নিয়ে কেন এক ঘরে ঘুমাতেন পিতা-মাতা; এমন প্রশ্নের উত্তরে শ্যালক দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, তিন সন্তানই কোনো না কোনোভাবে অসুস্থ থাকার কারণে তার বোন রোশনারা বেগম কখনোই সন্তানদের অন্যঘরে রেখে ঘুমাতেন না। ঢাকায় যে ৬ দিন অবস্থান করেছিলেন সেখানেও হোটেলের একটি কক্ষে তারা বসবাস করেছেন। আর তাজপুরে বাসা ভাড়া নেয়ার পরও তারা এক রুমে ঘুমাতেন।
তিনি জানান, ছোট ছেলে মাহিকুল ছিল প্রতিবন্ধী। সে একা বাথরুমে যেতে পারতো না। আর সাদিকুলের পায়খানায় সমস্যা। তাকে নল দিয়ে পায়খানা করানো হয়। এ কারণেই তাদের এক ঘরে থাকা। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় রফিকুল ইসলাম তাজপুর বাজারের একটি ফার্স্টফুডের দোকান থেকে বার্গার নিয়ে এসেছিলেন। ওই বার্গার খেয়েছে বড় ছেলে। অন্যরা ভাত খেয়েছেন। এদিকে ঘটনার দুই দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার সিলেটের ওসমানীনগর থানা পুলিশ এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করেছে। আর এ মামলার বাদী মারা যাওয়া রফিকুলের শ্যালক দেলোয়ার হোসেন। অপমৃত্যুর মামলা হলেও পুলিশ ঘটনার তদন্ত থেকে সরে যায়নি। বরং পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি টিম তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ঘটনার তদন্তে পরিবারের ভেতরের রোগ-ব্যাধী ও অশান্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে ছিলেন ১০ জন। এরমধ্যে কেবল যুক্তরাজ্য প্রবাসী পরিবারই আক্রান্ত হয়েছেন।
ডাক্তাররা ধারণা দিয়েছেন বিষক্রীয়ার। তবে কী ধরনের বিষ তাদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে সেটি জানা যাবে রিপোর্ট আসার পর। সব মিলিয়ে তদন্তের চূড়ান্তে পৌঁছাতে কিছুটা সময় নিতে হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী পরিবারের মধ্যে পিতা রফিকুল ও ছোট ছেলে মাহিকুল ইসলাম মারাই গেছেন। মা রোশনারা বেগম ও মেয়ে সামিরা ইসলামের অবস্থা ছিল গুরুতর। এখন তারা সুস্থ হচ্ছেন। তবে বড় ছেলে সাদিকুল ইসলামকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। বড় ছেলে সাদিকুল ইসলামের বিষক্রিয়া তেমন আক্রমণ করতে পারেনি। সে বার্গার খেয়েছিল। আর অন্যরা রাতে ভাত খেয়েছিল। সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) লুৎফুর রহমান জানিয়েছেন, ‘আমরা সব বিষয়কে মাথায় নিয়েই তদন্ত চালাচ্ছি। ডাক্তারি রিপোর্টের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। রিপোর্ট আসার পর জানা যাবে কী কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে। তদন্তের বাইরে পরিবারও নয়। চিকিৎসকের অনুমতি সাপেক্ষে সুস্থ হওয়া প্রবাসী পরিবারের সদস্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান তিনি।’