১৯৬৮ সালে চীনের বিপ্লবীদের কাছে চেকোস্লোভাকিয়ার ওপর সোভিয়েত আক্রমণ ছিল একটি দানবীয় অপরাধের সমান । বেইজিং থেকে চেয়ারম্যান মাও সেতুং এবং তার সহযোগীরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন : এক সময়ের গর্বিত সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন “সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদীদের” দ্বারা শাসিত , আমেরিকার মূল সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির দায়িত্বে থাকা পুঁজিবাদীদের সমতুল্য। প্রকৃতপক্ষে মাওয়ের ডেপুটি, ঝাউ এনলাই সোভিয়েত নেতাদের আমেরিকার সাথে সক্রিয় যোগসাজশের জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। বিশ্বকে দুটি ক্ষেত্রে বিভক্ত করার একটি পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছিলো তলে তলে। একটির নিয়ন্ত্রণ থাকবে মস্কোর হাতে এবং অপরটির ওয়াশিংটনের হাতে। ঝাউ এর অভিযোগ রাশিয়ার আক্রমণ সেই চুক্তির প্রমাণ ছিল। সোভিয়েত কর্তারা প্রাগের রাস্তায় গর্জন করার জন্য ট্যাঙ্ক পাঠানোর সাহস করেছিলেন, কারণ তারা জানতেন যে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করবে না। চীনা ক্ষোভ এতো তীব্র ছিল যে তা প্রাগে উদার সংস্কারের জন্য কোন সহানুভূতির সংকেত দেয়নি।
স্থানীয় পার্টির বস আলেকজান্ডার ডুবসেককে গ্রেফতার করে মস্কোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরিবর্তে, মাও কর্মকর্তারা আগ্রাসনকে একটি বিপ্লবী সংগ্রাম হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন , বীর চেকোস্লোভাক জনগণকে “ফ্যাসিবাদী” সোভিয়েত দখলদারদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিলেন। পরে, আক্রমণের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য কমিউনিস্ট কূটনীতিকরা মুখ খুললে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে চীন । সোভিয়েত নেতাদের দিকে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে বেইজিংয়ের পিপলস ডেইলি পত্রিকা জানতে চেয়েছিল: “আপনারা পুরো চেকোস্লোভাকিয়া দখল করতে কয়েক হাজার সৈন্য প্রেরণ করেছেন। এখন কোন ‘আঞ্চলিক অখণ্ডতার’ কথা বলছেন ?” সেই মাও-যুগের শত্রুতার অর্ধ শতাব্দী পরে, যা শেষ পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত চীন-সোভিয়েত সীমান্ত যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল, গোটা বিশ্বব্যবস্থা উল্টে দিয়েছিল। সেসব এখন অতীত।
চীনের নেতা, রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং, রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের এখন সর্বোত্তম বন্ধু ।যেহেতু মিঃ পুতিন ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিনা প্ররোচনায় আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি তার যুদ্ধের উদ্দেশ্য গোপন করেননি। তিনি ৪৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রতিবেশী দেশটিকে একটি নিরপেক্ষ, অসামরিক ক্ষেত্রে পরিণত করতে চান। জার্মান চ্যান্সেলর, ওলাফ স্কোলজের ভাষায়: “পুতিন সেখানে একটি রাশিয়ান সাম্রাজ্য তৈরি করতে চান।” প্রেসিডেন্ট শি এবং তার সরকার ইউক্রেনের সংঘাতের প্রতি তাঁর ছদ্ম-নিরপেক্ষতার ভঙ্গি বজায় রেখেছে, তবে কেউই চীনের রুশপন্থী ঝোঁক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে না। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ওয়াং ই পশ্চিমা সরকারগুলিকে রাশিয়ার “বৈধ নিরাপত্তা দাবি”-কে অনুমোদন করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে রাশিয়াকে ২৭ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সমানভাবে রাখার আবেদন করেছেন। দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিয়ে ফাঁকা আওয়াজ তোলার পর চীনের রাশিয়ান বন্ধুরা যখন ইউক্রেনকে টুকরো টুকরো করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সোভিয়েত প্রোপাগান্ডাকে প্রতিধ্বনিত করছে তখন চীন কি বলবে ? চীনা কর্মকর্তারা রাশিয়ার কাছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, কার্যকর এবং টেকসই ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখার বৈধ ইচ্ছার কথা বলেছেন। ৪ ফেব্রুয়ারি বেইজিং-এ শীতকালীন অলিম্পিক শুরুর কয়েক ঘন্টা আগে মিঃ শি এবং মিঃ পুতিনের দ্বারা সম্মত একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল , ”চীন ইউরোপে দীর্ঘমেয়াদী, নিরাপত্তার গ্যারান্টিসহ রাশিয়ার প্রস্তাবগুলিকে সমর্থন করছে ”। সহজ ভাষায়, রাশিয়া ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং জোটের উপর ভেটো দেওয়ার দাবি করছে। বেইজিং-এর একজন চীনা পণ্ডিত বলছেন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা নীতিগুলির দোহাই দিয়ে রাশিয়াকে টার্গেট করা উচিত নয় বা রাশিয়ার ইচ্ছাকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। ইউরোপীয়দের একাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- অর্থাৎ সোজা কথায় আমেরিকাকে চলে যেতে হবে। অন্যান্য সরকার বুঝতে পারছে তারা কী ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কেন তার দেশ রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে প্রস্তুত, যদিও তারা ঐতিহ্যগতভাবে সমস্ত বৃহৎ শক্তির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়। তিনি বলেছেন , “এটি আমাদের কাছে অস্তিত্বের সমস্যা। ইউক্রেন রাশিয়ার তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক বড়।” ছোট রাষ্ট্রগুলির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান।
চীনের স্বপ্ন আমেরিকার পশ্চাদপসরণ
মিঃ পুতিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ চীনা জাতীয়তাবাদীদের কাছে বিশ্বের বড় বড় দেশ দাবি জানিয়েছে, তারা যেন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাশিয়াকে সমর্থনকারী তাদের পোস্টগুলি সরিয়ে নেয়। চীন জানেই না ন্যাটো একটি যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি যা রাশিয়ার দাঙ্গায় ভীত প্রাক্তন কমিউনিস্ট-ব্লক দেশগুলির দাবির প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছিল । পরিবর্তে, আটলান্টিক জোটকে আমেরিকান আগ্রাসনের একটি হাতিয়ার হিসাবে তারা দেখে। যুগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার জন্য আমেরিকা এবং তার মিত্রদের দ্বারা ব্যবহৃত বাহন হিসেবে ন্যাটো সবচেয়ে বেশি পরিচিত চীনের কাছে , যাকে তারা অবৈধ হস্তক্ষেপ বলেই মনে করে । ন্যাটো ১৯৯৯ সালের মে মাসে কসোভো যুদ্ধের সময় বেলগ্রেডে চীনা দূতাবাসে বোমা হামলা করেছিল, যাকে চীনের সরকার মেনে নিতে পারেনি । এখনো দূতাবাসে বোমা হামলার তারিখটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ চীনা অস্ত্র কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে স্মরণ করা হয়, “প্রজেক্ট ৯৯৫” নামে । যেদিন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল, সেদিন চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুয়া চুনয়িং পশ্চিমের বিরুদ্ধে চীনা সার্বভৌমত্ব পদদলিত করার অভিযোগ এনেছিলেন , সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে “ন্যাটো এখনও চীনা জনগণের রক্তের ঋণী।” মিঃ পুতিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে মিঃ শি কতটা আগে থেকে জানতেন তা অবশ্য কখনই জানা যাবে না। কিন্তু চীনের কূটনীতিকরা রাশিয়ার আক্রমণে চমকে উঠেছিলেন। এই যুদ্ধ যা চীনের রুশপন্থী অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল করে তুলতে পারে । কিন্তু বেইজিং মনে করে , মিঃ পুতিনের আগ্রাসন থেকে তারা লাভবান হতে পারে। কারণ আমেরিকাকে ইউরোপের দিকে বেশি মনোযোগ দিলে ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে তাদের মনোযোগ কমে যাবে । চীন চায় এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের একটি ক্ষেত্র , যেখানে তারা অপ্রতিরোধ্য হবে। ফলস্বরূপ, চীন রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদের সাথে তার সংযোগ স্থাপন করেছে।
সূত্র : www.economist.com