ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ এবং দেশটিতে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এর মধ্যে ৪০ হাজারের মতো শ্রমিক অবৈধভাবে অবস্থান করছে। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র মালদ্বীপেই সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি অনিয়মিতভাবে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ অতিমারিকালীন সময়ে মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশ থেকে নতুন করে প্রবাসী কর্মী নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। উল্টো অনিয়মিত ও অদক্ষ শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে। মালদ্বীপ সরকারের ওই অনুরোধ নিয়ে এখন তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ।
বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটিও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এ কারনে গত ৫ই জানুয়ারি ও সর্বশেষ ১৪ই ফেব্রুয়ারি কমিটির বৈঠকে মালদ্বীপ ইস্যু নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। এতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম,সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান,পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক(দক্ষিণ এশিয়া) ফাইয়াজ মুরশিদ কাজীসহ কমিটির সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেন।
মালদ্বীপ সরকার অবৈধ শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানালেও বাংলাদেশ চায় তাদেরকে সেখানে বৈধভাবে থাকার সুযোগ তৈরি করতে। পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের জন্য মালদ্বীপ সরকারের সাথে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণলায়ের উদ্যোগে অবৈধ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সেখানে বৈধ করার মাধ্যমে মালদ্বীপে নতুন করে কর্মসংস্থানের বিষয়ে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা গতিলাভ করতে পারে।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সামঞ্জস্য এবং ভৌগোলিক দূরত্ব বিবেচনায় মালদ্বীপ অভিবাসনেচ্ছু বাংলাদেশিদের অন্যতম পছন্দ হলেও প্রায় ৪ লাখ জনসংখ্যার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র মালদ্বীপে প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসীর কর্মসংস্থানের পর নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। তবে, পর্যটন গন্তব্য হিসেবে খ্যাত মালদ্বীপের ৭০ টি দ্বীপে রিসোর্ট নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। নির্মাণকাজ শুরু হলে কিছু বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশা করা যায়। এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনিয়মিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়মিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে।
মালদ্বীপ ইস্যুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দ্রুত বৈধ করার বিষয়ে মালদ্বীপ সরকারের সাথে আলোচনা হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন,বাংলাদেশের শ্রমিকরা মালদ্বীপ কারেন্সিতে বেতন পায়। কিন্তু দেশে অর্থ প্রেরণের সময় অনেক উচ্চমূল্য দিয়ে ডলারে রূপান্তর করে দেশে অর্থ প্রেরণ করতে হয়। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিধায় শ্রমিকদের বেতন ডলারে প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলেও তাতে তারা রাজি হয়নি। ভবিষ্যতে মালদ্বীপে নির্মাণ ও সার্ভিস সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে প্রচুর শ্রমিকের দরকার হবে।
মালদ্বীপ মাছ এবং নারিকেল ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানি করে বিধায় বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে শিপিং লাইন চালু করার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে বলে তিনি জানান। একই ইস্যুতে প্রতিমন্ত্রী ও কমিটির সদস্য মোঃ শাহরিয়ার আলম বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি বিধায় এই সেঞ্চুরিকে বলা হয় এশিয়ান সেঞ্চুরি। তাই এই অঞ্চলের প্রতি পৃথিবীর সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর একটি বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এমন একটি পর্যায়ে রয়েছে তাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন,দীর্ঘদিন থেকেই মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরের মাধ্যমে এই সম্পর্ক আরও উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মালদ্বীপের মিলিটারি ক্যাডেটরা প্রতি বছর দুইজন করে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন, যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মালদ্বীপ ছোট দেশ হলেও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে তারা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে। তিনি বলেন, মালদ্বীপে প্রায় ১ লক্ষের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করে। কোভিড পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে সেখানে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়ে অবৈধ হিসেবে বসবাস করছে। এই অবৈধ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মালদ্বীপে শ্রম বাজার সম্প্রসারণের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। একই সাথে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি নৌ-যোগাযোগ স্থাপন করে ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার বিষয়টি মালদ্বীপের সাথে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিতভাবে গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করে থাকে। মালেতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মালদ্বীপের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে প্রথম ফরেন অফিস কন্সাল্টেশনসহ উক্ত সফরে অনুষ্ঠিত মালদ্বীপের মিনিস্ট্রি অব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট এর মন্ত্রী উজ ফায়াজ ইসমাইল-এর সাথে পররাষ্ট্র সচিবের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। এতে কোভিড পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে কর্মসংস্থান হারিয়ে মালদ্বীপ অবস্থানরত অবৈধ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সেখানে বৈধ করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে উক্ত কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র সচিব নিজ মন্ত্রণালয়ে বিষয়সমূহ অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়,গত বছরের ২২-২৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপে রাষ্ট্রীয় সফরকালে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতে অবৈধ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সেখানে বৈধ করার প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়। এ দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় “অবৈধ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সেখানে বৈধ করার বিষয়ে” প্রয়োজনীয় নেগোসিয়েশনসহ প্রধান সমন্বয়কারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। উল্লেখ্য, মালদ্বীপ কর্তৃক প্রস্তাবিত “MoU on Cooperation on matters relating to Migrant Workers between Bangladesh and Maldives” শীর্ষক চুক্তিটির খসড়া চূড়ান্তকরণের বিষয়ে কাজ চলমান রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের কাজ করে যাচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের অধীন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সংস্থার মাধ্যমে মালদ্বীপে অবস্থানরত অবৈধ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সেখানে বৈধ করার বিষয়ে প্রধান বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
মালদ্বীপের সঙ্গে সরাসরি নৌ-যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে,বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে সরাসরি নৌ- যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নিয়মিতভাবে আলোচনা করছে। গত বছরের ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরের সময় তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উত্থাপন করেন। ইতোপূর্বে মালদ্বীপের সাথে ফরেন অফিস কনসাল্টেশনের সময়ও পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) বিষয়টি আলোচনা করেন। প্রতিবেদনে ওই উদ্যোগের বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে-এ লক্ষ্যে প্রথমেই একটি চুক্তি সম্পাদন করা জরুরি অনুধাবন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে সরাসরি নৌ-যোগাযোগ স্থাপনের নিমিত্ত চুক্তির খসড়া প্রণয়নে নৌ পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি পত্র প্রেরণের মাধ্যমে অনুরোধ জানায়।
এর প্রেক্ষিতে নৌ পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সকল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রভৃতি) মতামত গ্রহণপূর্বক গত বছরের ১৮ নভেম্বর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করে। নৌ পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে সরাসরি নৌ যোগাযোগ স্থাপনের নিমিত্ত চুক্তির খসড়া প্রণয়ন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে মর্মে অবহিত করে। খসড়া প্রেরণের জন্য বিগত ১৯ জানুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে আরেকটি পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে সরাসরি নৌ-যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় নৌ পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রধান বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বয়কারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে।